যুগাবতার শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে কথাশিল্পীর অমূল্য কথোপকথন

যুগাবতার শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে কথাশিল্পীর অমূল্য কথোপকথন
(সংক্ষেপে)

১৩২০ - ১৩২৫ সাল শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবসমাধির যুগ। কম সময় নয়, দীৰ্ঘ পাঁচ বছর। কীৰ্ত্তনের সাথে সাথে পরমপুরুষ বিভিন্ন গান লিখে সংকীতৰ্ন করতেন। দলে দলে লোক সংকীৰ্তনে যোগ দিতেন। সে কাহিনী "ভাব সমাধি অবস্হায় শ্রীশ্রীঠাকুর" বা "S.S.Thakur in Trance" পৃষ্ঠায় বিস্তারিত লেখা হবে। ভাবসমাধি অবস্হায় ঘটত অত্যাশ্চৰ্য কত ঘটনা। বাহ্য চেতনাহীন হয়ে পড়ত শ্রীশ্রীঠাকুরের দেব তনু। ডাক্তারী পরীক্ষায় প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যেত না। নিথর দেহ থেকে হঠাৎ গঙ্গোত্রীর ধারার মত ঐশী বাণী নিৰ্গত হতো। চারদিকে রটে গিয়েছিল অনুকূল জীবনের বারতা। বিদেশ পৰ্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল অনুকূল আলো।
যে আলো ছড়াবার
তা তো যাবেই ছড়িয়ে-
বন্ধ করে তারে
রাখবে কি দিয়ে?
তখন থেকে শুরু হয়েছিল জনবন্যার স্রোত। অনেক জ্ঞানী গুণীর মধ্যে অমর কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এসেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে। ১৩৩২ সনে পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রমে ঠাকুরের শিক্ষাদৰ্শে প্রতিষ্ঠিত তপোবন স্কুলের অনুষ্ঠান ও শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মোৎসব উপলক্ষে কথার যাদুকর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহোদয় পাবনায় এসে পরমপুরুষের সাক্ষাৎধন্য হন। শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার কিছু অংশ উল্লেখ করা হল-
শরৎচন্দ্র - কত লোক যে আত্মস্বীকৃতি জানিয়ে আমাকে পত্র দিয়েছে, তার সীমা নেই। তাদের কথা নিয়েই আমি উপন্যাস রচনা করেছি।
শ্রীশ্রীঠাকুর - আমার কাছেও কত লোক যে confession করেছে এবং তা যে কি বীভৎস তা কাউকে জানাবার উপায় নেই। কারণ তারা বলেছে,- একথা যেন গোপন থাকে। আমি তাতেই বুঝতে পারি আমাদের সমাজ কত পচে গিয়েছে। আমি ঘুমোতে পারি না, বায়োস্কোপের ছবির মত তা চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই অবস্হায় প্রতিকারের জন্য যা যা করণীয় তাই আমি সবাইকে বলি। -সমাজ পচে গিয়েছে সত্য, কিন্তু তাই বলে আমরা যদি দুঃখের চিত্র, হতাশার চিত্র, বিকৃত মনস্তত্ত্বের অভিব্যক্তি লোকের সামনে তুলে ধরি, তবে কারও কোন উপকারই আমরা করতে পারি না। সাহিত্যিকের দায়িত্ব গঠনমূলক চিত্র তুলে ধরা, যার ফলে মানুষ হতাশার মধ্যেও আশা, দুঃখের মধ্যেও পায় শান্তির ঈঙ্গিত। বাস্তববাদের সঙ্গে যদি আদৰ্শবাদের সম্বন্ধ না থাকে, তবে কোন সুফলই হবে না। আদৰ্শ চরিত্র রুপায়ণ করলে, তা থেকে মানুষ পাবে উদ্দীপনা। বাস্তব অসুবিধা বা ভাগ্যবিপৰ্যয়কে প্রতিহত করে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে। সাহিত্যিক যদি পাঠকের মনে ভরসার সৃষ্টি করতে না পারে, কল্যাণের ঈঙ্গিত দিতে না পারে, তবে সে সাহিত্যের মূল্য কতটুকু?
শরৎবাবু তন্য় হয়ে শুনছিলেন। সাহিত্যের রুপরেখা সস্পৰ্কে যুগশিক্ষক শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠ শুনে কথাশিল্পী বললেন, "এমন করে কখনও ত ভাবিনি। এতদিন ভাবনার ধারণাটাই ছিল উল্টো রকমের। সমস্যাটা তুলে ধরেছি। সমাজসংস্কারক করবে তার সমাধান।"
শিল্পীমহোদয়ের বয়স তখন ভাটার দিকে। অত্যন্ত চিন্তাম্বিত হয়ে শরৎবাবু বললেন, এখন কি আর শেষ সময়ে অন্য ভাবের রচনা সৃষ্টি করতে পারবো?
উল্লেখ্য শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে আলোচনা শেষে জীবনের ক্রান্তি লগ্নে কথাশিল্পী লিখেছিলেন 'বিপ্রদাস।'
প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা এগিয়ে চলল। শরৎবাবুর আরও কিছু প্রশ্ন নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
শরৎচন্দ্র - সব বিষয়েরই কি solution হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর - সকল বিষয়েরই solution হয়, কেবল supreme cause - এর solution হয় না।
শরৎচন্দ্র - মানুষের প্রবৃত্তি খরাপ দিকেই যায় কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর - যে কাজে আপাতত সুখ আছে, মানুষ তাতেই আসক্ত হয়, কিন্তু তার পরে যে দুঃখ আসে তখন তা মনে করে না। যেমন একজন মদ খেল, খেয়ে নেশা হলো, স্ফূৰ্তি হলো, কিন্তু পরক্ষণেই কতরকম অবসাদ অশান্তি আসে।
শরৎচন্দ্র - পাপ পুণ্য কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর - যে কাজে মনের প্রসারণ নিয়ে আসে, আনন্দ নিয়ে আসে, তাই পুণ্য। আর এর বিরোধী যা, অৰ্থাৎ যে কাজে মনের সঙ্কোচ নিয়ে আসে, বিষাদ নিয়ে আসে, মৃত্যু নিয়ে আসে তাই পাপ।
শরৎচন্দ্র - ভগবান কি দেখা যায়?
শ্রীশ্রীঠাকুর - হাঁ।
শরৎচন্দ্র - ভগবানের উপর আমাদের ভলবাসা হয় না কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর - তাঁতে আমরা আসক্ত নই, অন্য বিষয়ে আসক্ত আছি, এই বুঝতে হবে। তাঁতে যখন আসক্ত হব, তখন অন্য দিকের আসক্তি কমে যাবে।
শরৎচন্দ্র - লোকের খারাপ কাজের দিকে tendency হয় কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর - আশু সুখদায়ক বলে। রসগোল্লা খেতে ভাল লাগে বলে খেতে খেতে চলল, কিন্তু শেষে পেটের পীড়া।

Comments